রাজধানীর মগবাজারের ওয়্যারলেস গেট এলাকায় গতকাল রবিবার সন্ধ্যায় হঠাৎ ভয়াবহ বিস্ফোরণে ‘রাখি নীড়’ নামে একটি তিনতলা ভবন ধসে নারী ও শিশুসহ অন্তত সাতজন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ওই ভবনের বাসিন্দা, সামনের রাস্তায় থাকা বাসযাত্রী, পথচারীসহ শতাধিক।

এর মধ্যে ৯ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। মৃতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে। ফায়ার সার্ভিস ও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার মুহা. শফিকুল ইসলাম এসব তথ্য জানিয়েছেন। কোথা থেকে কিভাবে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে, তা এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ফায়ার সার্ভিস ও ডিএমপি কমিশনারের ধারণা, গ্যাস থেকে এই বিস্ফোরণ হতে পারে। আবার কেউ কেউ বলছেন, কোনো ট্রান্সফরমার বিস্ফোরিত হয়েছে।

কেউ বলছেন, কোনো ভবনের জেনারেটর কিংবা এসি থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে। ঘটনা তদন্তে চার সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। গতকাল রাত সাড়ে ১২টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের ১৪টি ইউনিট উদ্ধারকাজ চালাচ্ছিল। বিস্ফোরণে রাখি নীড় ছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আশপাশের বেশ কয়েকটি ভবন, তিনটি যাত্রীবাহী বাসসহ বেশ কিছু যানবাহন। আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউট, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল ও কমিউনিটি হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকা মেডিক্যালে ৩৮ জন এবং বার্ন ইনস্টিটিউটে ১০ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আহতদের মধ্যে কয়েকজন দগ্ধ হয়েছে। বেশির ভাগই ভবনের বিস্ফোরিত অংশ ও কাচের আঘাতে আহত হয়েছে। সন্ধ্যায় ব্যস্ত রাস্তায় বাসে যাতায়াতের সময় বা রেস্টুরেন্টসহ বিভিন্ন স্থানে গিয়ে আকস্মিকভাবে হতাহতের শিকার হয়েছে অনেকে। রাতে হাসপাতালে স্বজনরা আহাজারি করছিল।

ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের কর্মকর্তারা জানান, মগবাজার থেকে মৌচাকের আউটার সার্কুলার রোডের ৭৯ নম্বর রাখি নীড় ভবনের শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) বিস্ফোরণের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ভবনটির নিচের অংশে বিস্ফোরণের পর দেবে যাওয়া জেনারেটর বা গ্যাসলাইন থেকে বিস্ফোরণ ঘটেছে কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আশপাশের অর্ধশতাধিক ভবনের কাচ ও বিদ্যুতের খুঁটি ভেঙে পড়ায় বৈদ্যুতিক কোনো গোলযোগ আছে কি না তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও সরেজমিনে গিয়ে জানা গেছে, রাখি নীড় নামের ভবনটির কাছে ড্রেনের সংস্কারকাজ চলছে।

গ্যাসলাইনের সংযোগের লিকেজ, ট্রান্সফরমার বা ভবনের জেনারেটর থেকে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়েছে। এতে ভবনটির কাচসহ ভবনের কিছু অংশ ধসে সামনের রাস্তায় থাকা বাস ও যানবাহনের ওপর পড়ে। এতে তিনটি বাস দুমড়ে-মুচড়ে যায়। কয়েকটি বিদ্যুতের খুঁটিও রাস্তার মধ্যে পড়ে। ভবনের উত্তর পাশে রাস্তার উল্টো দিকে বিশাল সেন্টার, আড়ংয়ের ভবনের কাচও ভেঙে নিচে পড়েছে। মগবাজার ফ্লাইওভারের গোড়ায় রাস্তার দুই পাশের অর্ধশত ভবনের ক্ষতি হয়েছে। রাখি নীড়ের নিচতলায় শর্মা হাউস, সুইটস বেঙ্গল মিটসহ কয়েকটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ছিল। বিস্ফোরণের পর নিচতলা পুরো ধ্বংস হওয়ায় ভবনটি কয়েক ফুট দেবে গেছে বলে জানিয়েছেন উদ্ধারকারীরা।

রাতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এখন পর্যন্ত তাঁরা জানতে পেরেছেন, শর্মা হাউসের বিস্ফোরণে আশপাশের সাতটি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া তিনটি বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মারা গেছে মোট সাতজন। তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে নাশকতার তথ্য পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ভবনটির নিচতলা থেকেই বিস্ফোরণ ঘটেছে। কারণ তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।

এটি নাশকতা কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপি কমিশনার বলেন, ‘আমার কাছে মনে হচ্ছে না।’ রাতেই ঘটনাস্থলে ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট আগুনে বিস্ফোরক ছিল কি না তা যাচাই করেছে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, ‘গ্যাসের কারণে বিস্ফোরণ ঘটছে। তবে কিসের মাধ্যমে বা কী কারণে ঘটনা ঘটেছে তা তদন্ত করে বলা যাবে। এই ঘটনায় তিনজন মারা যাওয়ার তথ্য আছে আমাদের কাছে। এই ঘটনা চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এটা নাশকতা কি না সেটিও বলা যাচ্ছে না।’ তিনি বলেন, ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ। এটা বলতে রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করতে হবে না। ভবনটির সামনে রাস্তায় ড্রেনেজ লাইনের কাজ হচ্ছে। সেটার কারণে লিকেজ হতে পারে। কোনোটিই নিশ্চিত নয়। তদন্তের পর বলা যাবে। তিনি আরো বলেন, বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটার কারণে আশপাশের ভবনের কাচ ভেঙে পড়েছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। গতকাল রাত পর্যন্ত নিহতদের মধ্যে তিনজনের পরিচয় জানা গেছে। তাঁদের মধ্যে জান্নাত (২৩) নামে এক নারী ও তাঁর ১০ মাসের শিশুসন্তান সোহানা। জান্নাতের স্বামী সুজন ঢাকা মেডিক্যালে বিলাপ করে বলেন, হোটেলে খেতে গিয়ে জীবনটা শেষ হইয়া গেল।’ তিনি জানান, ওয়্যারলেস রেলগেটে তাঁদের বাসা। গতকাল সন্ধ্যায় তাঁর স্ত্রী জান্নাত শিশু সোহানা ও ছোট ভাই রাব্বিকে (১২) নিয়ে শর্মা হাউজে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়। ঘটনাস্থল থেকে সোহানার লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়ার পর জান্নাতকে মৃত ঘোষণা করা হয়। রাব্বি ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গতকাল রাতে স্বপন নামে আরেকজন বার্ন ইনস্টিটিউটে মারা গেছেন। সেখানে আরো দুজনের মৃত্যু হয়। তাঁদের পরিচয় তাত্ক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। ফায়ার সার্ভিসের রমনা স্টেশন অফিসার ফয়সালুর রহমান বলেন, ‘সন্ধ্যা ৭টা ৩৫ মিনিটে এসি বিস্ফোরণের খবর পাওয়া যায়। ভবনটি দেবে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ। সেখান থেকে আমরা ছয়জনের মৃতদেহ পেয়েছি।’ ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, রাস্তায় লাব্বাইক পরিবহন, আজেমরী পরিবহন ও আল মক্কা পরিবহনের তিনটি বাস ভাঙাচোরা অবস্থায় পড়ে আছে। বাসের সিটের নিচে ও রাস্তায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। রাস্তায় পড়ে আছে ভাঙা কাচ। রাখি নীড় ভবনটির নিচে পুরোই যেন ধ্বংসস্তূপ। ওই ভবনের উল্টোদিকে আড়ং ও বিশাল সেন্টারের কাচ ভেঙে পড়েছে রাস্তায়। সোলায়মান কবির নামে এক বাসযাত্রীর গায়ের শার্ট রক্তে ভেজা।

এই প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘আমি পেছনের বলাকা পরিবহনে ছিলাম। গুলিস্তান থেকে মিরপুর-১৪ নম্বর যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বিকট একটা শব্দ হলো। রাস্তা বন্ধ হয়ে গেল। বাস থেকে নেমে দেখি রাস্তায় মানুষের আহাজারি।’ আরফান নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘বিকট শব্দে পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। ভবনের সামনের এবং পেছনের অংশ ধসে পড়েছে। সবাই ভয়ে ছোটাছুটি শুরু করে। কেউ বুঝতে পারিনি কী থেকে কী হলো।

শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন রায়হানুল গাফফার নয়ন জানান, ঘটনার সময় তিনি যাত্রীবাহী বাসে ছিলেন। হঠাৎ বিকট বিস্ফোরণে বাসের কাচ ভেঙে তিনি আহত হন। শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল জানান, সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিন ব্যক্তি মারা গেছেন। ভর্তি হওয়া আরো ৯ জনের অবস্থা গুরুতর। তাঁদের শরীর পোড়া ছাড়াও জখমের চিহ্ন রয়েছে। আশঙ্কাজনক আহতরা হলেন—রাসেল (২৪), জাকির হোসেন (৪০), নয়ন (৩২), মোতালেব (৪০), আবুল কালাম (৩৫), পইমল হোসেন (৪০), মোস্তাফিজ (৪৫), নবী (২৮) ও আজাদ (৩৫)। এ ছাড়া ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৩৮ জনকে ভর্তি করা হয়েছে। রাতে মগবাজার ও মৌচাক সড়কটি বন্ধ করে উদ্ধারকাজ চালানো হচ্ছে। এতে আশপাশের সড়কে তীব্র যানজট দেখা দিয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্ধন বলেন, ‘বিস্ফোরণের ঘটনায় ওই ভবনের নিচতলার অংশ উড়ে গেছে। ঠিক কী কারণে বিস্ফোরণ ঘটেছে সেটা আমরা তদন্ত করে দেখব।’ সবার আগে কাজ হচ্ছে হতাহতদের উদ্ধার করা। অনেকে ভেতরে আটকে পড়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। রাতেও উদ্ধার তল্লাশি চলছে।